বিষাক্ত দংশন
– রাখী চক্রবর্তী
ছয় মাসের মধ্যে দু’টো মৃত্যু, না আর দেরি করা ঠিক হবে না। হন্তদন্ত হয়ে সুশীলা বড় রাস্তার মোড়ের সামনে বালাজি ট্রাভেলস এজেন্সির অফিসে গিয়ে গয়া প্যাসেঞ্জার এক্সপ্রেসের দু’টো টিকিট কেটে বাড়ি ফিরলো।
ততক্ষণে মুদির দোকান বন্ধ করে তাপস বাড়ি চলে এসেছে। বাড়ি ফিরে সুশীলাকে না দেখতে পেয়ে তাপস চিন্তাতে পড়ে গেছে।
মিনিট দশেক পর সুশীলা বাড়ি ফিরে একমাত্র ছেলে বিবেক ও দেওর সন্তুকে বললো, অনেক দেরি হয়ে গেল, এবার তোদের খেতে দেবো। তুমিও স্নান সেরে নাও।
তাপস সুশীলাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললো, কোথায় গেছিলে জানতে পারি ম্যাডাম?
– সব বলবো। আগে এইটা দেখো..
-গয়ার টিকিট তো। তুমি আর সন্তু ! কি ব্যাপার হল হঠাৎ?
– হঠাৎ না। কদিন ধরে মনটা কু ডাকছে। ছ’ মাসের মধ্যে মা বাবার পরপর মৃত্যু। সন্তু, বিবেক, তুমি..খুব চিন্তা হয় জানো তোমাদের জন্য। মা বাবার আত্মার শান্তি জন্য গয়ায় যাব পিণ্ডি দিতে। তোমাকে না জানিয়ে কাজটা করলাম। কিছু মনে করো না। নাও স্নান সেরে খেয়ে নাও।
– সন্তু…বিবেক খেতে আয়।
-তোমার মতো গৃহিণী যেন প্রতি ঘরে ঘরে থাকে। সবার খেয়াল রাখো। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।
তাপস দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে সন্তুকে বললো, আমার ঘরে আয়।
পনেরো বছরের সন্ত নামেই বড় হয়েছে,বাচ্চা ভাব রয়েই গেছে এখনও। বাবা মার মুখাগ্নি, সৎকার ও শ্রাদ্ধ শান্তি করে খুবই ভেঙে পড়েছে ও। স্কুল যায় না। মা বাবার ফটোর সামনে চোখের জল ফেলে দিন রাত।
পাড়ার সবাই বলছিল বড় ভাই থাকতে ছোট ভাই কেন মুখাগ্নি করবে?
সুশীলা বলেছিল, মা বাবার ইচ্ছেতেই সব করছি।
যাক সে কথা সন্তু দাদার ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসলো।
তাপস বললো, বাবু গয়ায় গিয়ে বাবা মার নামে পিণ্ডি দিবি। ওখানে পুরোহিত সব কাজ তোকে দিয়ে করাবে। ঠিক মতো মন্ত্র বলবি। একটা ফল দান করতে হবে তোকে। যেই ফল দান করবি সেই ফল তুই এ জীবনে আর খেতে পারবি না। শশা দান করবি। ঠিক আছে। ভুলেও কিন্তু শশা মুখে দিবি না কোনোদিন। পরশু দিন রওনা দিবি। বৌদি সব বুঝিয়ে দেবে।
– তুমি যাবে না দাদা?
– না বাবু, আমার দোকান বন্ধ হলে চলবে না।সংসারটা চালাতে হবে তো।
-ঠিক আছে দাদা আমি যাই।
-হ্যাঁ যাও তোমার ব্যাগ আমি গুছিয়ে দেবো।
ধুতি, গেঞ্জি সব নতুন কিনে আনবো আজ রাতেই।
সন্তু মাথা নাড়িয়ে ঘরে চলে গেল।
সাত বছরের বিবেক খুব ভালো ছেলে। মা থাকবে না জেনেও ও খুব শান্ত হয়ে আছে। দু’দিনের জন্য তো। ও ওর বাবার সাথে দোকানে যাবে এই আনন্দ নিয়ে আছে।
সুশীলা ট্রেনে উঠে সন্তুকে বললো, কোনো কিছু নিয়ে একদম ভাববি না। আমি তো আছি। সন্তু বৌদির দিকে তাকিয়ে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
পিণ্ড দানের কাজ সম্পন্ন হল। বাড়ি ফিরে এল সুশীলা। দুপুর বেলায় সন্তু ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বৌদি.. বৌদি বলে চিৎকার শুরু করে দিল।
সুশীলা বললো, কি হয়েছে?
– মা, বাবা দাঁড়িয়ে আছে আমার খাট ধরে, ঐ দেখ..
– দুর পাগল ছেলে, গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে এলে আর আত্মা বলে কিছু থাকে না। মাথা থেকে ছাড় ওসব।
রাত্রি বেলায় তাপস দোকান বন্ধ করে আসার সময় ফজলি আম নিয়ে এলো।
সবাই খেতে বসেছে সুশীলা একটা আম চারটে পিস করে কাটল আমের আঠিটা আলাদা রাখল বিবেকের জন্য ।
কিন্তু সন্তু আম খেল না।
তাপস কতো করে বললো, বাবু তুই তো আম খেতে ভালবাসিস। আম খা।
সন্তু মুখে তুললো না আমের একটা টুকরোও। তাপস চিন্তাতে পড়ে গেল, ভাই আম ভালবাসে অথচ আম খাচ্ছে না।
সুশীলা বললো, বিবেককে আম দিয়ে এসো।
খাবারের দিকে তাকালেই সন্তু গা হাত ঝাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে, মুখে খাবারটুকুও তুলছে না। এ রকম চলতে থাকলে তো রোগে পড়ে যাবি বাবু। কি হয়েছে বল?
সন্তু মুখে রা কাটে না।
এক দিন করে করে দিন যায়, মাস যায়,
বৌদির পোঁতা আম গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সন্তু।
দু’ মাসের মধ্যে সন্তু এবার বিছানা নিয়ে নিল। ডাক্তার রোগ ধরতেই পারছে না।
পাড়ার সুবল ডাক্তার বললো, ভেলোরে নিয়ে যাও ভাইকে। যদি বাঁচানো যায়।
সুশীলা মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো সুবল ডাক্তারের কথা শুনে।পাড়ার সবাই বলাবলি করছে মা,বাবা না ছেলেটাকে টেনে নেয়।
সুশীলা বলছে, চুপ করো তোমরা চুপ করো।কিচ্ছু হবে না সন্তুর।
তাপস দোকানে যায় ঠিকই কিন্তু বেশিক্ষণ দোকানদারি করে না। বাড়ি ফিরে সন্তুর মাথার কাছে বসে থাকে।
“দেখিস তপু, ভাইটাকে জলে ফেলিস না”
মরার আগে মার শেষ আজ্ঞা। পালন করবেই তাপস। মা অন্ত প্রাণ ছিল তাপস। বাবার মৃত্যু তো হঠাৎ হল। রাত্রি বেলায় পায়খানা বমি হল, ভোরেই মৃত্যু। ছ’ মাস যেতে না যেতেই মার ধুম জ্বর, মা জ্ঞান হারালো আর উঠল না। জ্বরের মধ্যে একবার বলে উঠলো মা, “দেখিস তপু,ভাইটাকে জলে ফেলিস না”
সব শেষ হয়ে গেল।
না না.. বাঁচাবো সন্তুকে। ভেলোরে নিয়ে যাব, বাড়ি বিক্রি করতে হলে তাই করবো।
এ দিকে সুশীলার বাবা খুব অসুস্থ খবর এলো। সুশীলাকে যেতেই হবে বাড়ির বড় মেয়ে। আবার এদিকে সন্তুর এই অবস্থা।
তাপস সুশীলাকে অনেক বুঝিয়ে বাপের বাড়ি পাঠাল দু’দিনের জন্য।
সুশীলা বললো, কালকেই চলে আসব সন্তুর এই অবস্থা।
তাপস আর না করল না।
সকালে রওনা দিল সুশীলা ।
দুপুরে ভাইকে খাইয়ে দিতে গিয়ে তাপস দেখলো, ভাই ভুল বকছে। মাথায় হাত দিয়ে দেখলো, পুড়ে যাচ্ছে কপালটা ওর। ভালোই তো ছিল। জ্বর তো ছিল না।
“আম কোনদিন খাব না বৌদি। খেতে ইচ্ছে হলেও না। আম খেতে ভালবাসি..খুউব
– এই সন্তু কি হয়েছে? আম খাবি বাবু?
-না, বৌদি বকবে যে। মা বাবাকে দিয়েছি তো আম,দান করেছি।
-কি বলছিস! আমি যে বললাম শশা দিতে। তুই দিসনি?
-বৌদি মানা করলো তো..আম দান করলে আমি মা বাবার কাছে যেতে পারবো খুব তাড়াতাড়ি। তাই তো..
– চুপ কর। আমাকে বলিস নি এতো দিন হয়ে গেল।
– দাদা আমি বাঁচতে চাই না।আমি মরলে তবেই..
– কি তবে.. বল ভাই বল?
– বিবেক সব পাবে। সন্তুর মুখ বন্ধ হয়ে আসছে। তাপস চিৎকার করে বললো, বল ভাই সব বল..
– একটা শিশি ওষুধের, আমার বাক্সে আছে। মা ও বাবাকে খাওয়াতো বৌদি, আমাকে দেয় রোজ রাতে। তোমাকে দিলে খেও না।
সন্তু কথা বল, মুখ বন্ধ হয়ে গেল কেন তোর?
তাপস সন্তুর ঘরে রাখা বাক্সর ভেতর থেকে ওষুধের শিশিটা নিয়ে সুবল ডাক্তারের কাছে গেল।
সুবল ডাক্তার বললো, এই ওষুধ স্লো পয়েজন করে মানুষ মারে। মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। অসুস্থ হয় প্রথমে তারপর বিছানা নেয় তারপর..কোথায় পেলে তাপস এই ওষুধের শিশি?
তাপস এক ছুটে বাড়ি চলে গেল। সন্তু বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।
সুশীলাকে ডেকে পাঠালো তাপস।
কান্নায় ভেঙে পড়েছে সুশীলা, তাপস সুশীলার চুলের মুঠি ধরে বললো, বিষের থেকেও বিষাক্ত তোমার মুখ, তোমার দেহ, ,তোমার মন। তুমি লুকিয়ে রেখেছিলে এতো বছর ধরে তোমার বিষাক্ত চেহারা। আমার মা বাবাকে তোমার বিষাক্ত দংশনে শেষ করেছো, শেষে আমার ভাইকেও..
তোমার নিঃশ্বাসে এতো বিষ ভরা ছিল, বুঝতে পারিনি। সাপের থেকেও তুমি বিষাক্ত।
আজ তোমার বিষ দিয়ে তোমাকেই মারব বলে তাপস শিশির মধ্যে থাকা সব ওষুধ সুশীলার মুখের মধ্যে ঢেলে দিল।
সুশীলার শরীর আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়লো। তাপস খাটের ওপর শুইয়ে দিল সুশীলাকে।
সন্তুকে কলকাতার পিজি হসপিটালে নিয়ে গেল তাপস। দু’ ঘণ্টা পর সন্তু চোখ খুললো।
দাদাকে দেখেই হাতটা বাড়িয়ে দিল সন্তু।
বিবেক, বিবেক.. বললো দু’বার।
দু’দিন পর সন্তু বাড়ি এল। বৌদিকে বিছানায় শয্যাশায়ী দেখে সন্তু বললো, বৌদি ওঠো। আমি আর এখানে থাকবো না। তুমি ভালো থেকো বিবেককে নিয়ে।
তাপস সন্তুকে নিয়ে গুরুদেবের আশ্রমে গেল। ওখানেই ও থাকবে এখন থেকে।
এক বছর হয়ে গেল সন্তু বাড়ির বাইরে ।সুশীলার গৌর বর্ণ নীলাভ হয়ে গেছে।
সুশীলার পোঁতা আম গাছে প্রচুর আম ফলেছে। তাপস মুখে দিয়েও দেখেনি। ভাই ভালবাসত আম খেতে। সেই ভাই জীবনে আম মুখে তুলবে না কি করে দাদা খায় সেই আম!
গাছ থেকে আম পেড়ে, এক ঝুড়ি আম নিয়ে তাপস সুশীলাকে দিয়ে বললো, খাও প্রাণ ভরে খাও। সফল হয়েছে তুমি, আমার ভাইয়ের ভাগ, আমার ভাগের সব আম খাও।
কি বুদ্ধি! বলেই তাপস একটা ব্যাগ নিয়ে চিরদিনের জন্য ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, গুরুদেবের আশ্রমে থাকবে বলে, ভাইয়ের সাথে।
সুশীলা নিজের বিষে জ্বলছে পুড়ছে, মরছে শতবার..হাজার বার।